বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই কাপিং থেরাপি বেশ জনপ্রিয়। সৌদী, মিশর,মালয়শিয়া কিংবা চীনে যেমন চলছে, তেমনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি নরওয়ে ডেনমার্কের মত দেশেও দিব্যি চলছে সগৌরবেই। ডেনমার্ক এবং নরওয়ে তে ইতোমধ্যেই প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে কমপ্লিমেন্টরি মেডিসিনকেও গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।
শুধু কাপিং ই নয়, জরিপ বলে, অস্ট্রেলিয়াতে প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের সব ধরনের ট্রেডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন গ্রহণের হারও বেশ অবাক করার মতন এবং যা দিন দিন বাড়ছে!
কাপিং নিয়ে সাম্প্রতিক হুলস্থূলের সূত্রপাত গত অলিম্পিকে মাইকেল ফেলেপ্সের কাপিং মার্কের ছবি ভাইরাল হবার পরে। এছাড়া সে বছর আরো অনেক এথলেটসদেরই কাপিং এর দাগ গায়ে মঞ্চে উঠতে দেখা গেছে।
খোদ কানাডার প্রসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো, ফুটবলার নেইমার, ক্রিকেটার ভিরাট কোহলি, অভিনেত্রী জেনিফার এনিস্টন, গায়ক জাস্টিন বিবার – মোটামুটি সব শাখার সেলিব্রেটিরাই কাপিং এ নিজেকে সঁপে দিতে পিছপা হননি!
বৈজ্ঞানিক নাকি অবৈজ্ঞানিক এর তর্ক ডিঙিয়ে উপকারী নাকি অপকারী সেই দিকে সবার দৃষ্টি গেছে!
তাইতো বিভিন্ন রিসার্চ পেপারে কাপিং আলোড়ন তুলেছে।এই যেমন, সম্প্রতি হারভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক রিপোর্টে কাপিং থেরাপি ও আকুপাংচারের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মারাত্মক ব্যাথা বা বাচ্চাদের দীর্ঘমেয়াদী রোগ এগুলোতে এসব থেরাপি অধিকাংশক্ষেত্রে বেশ ভাল কার্যকর!
এই যে দেশে দেশে কাপিং থেরাপির জয়জয়কার, এর শুরুটা কোথায়? অনেকেই এসে বলেন, রাসুল সাঃ কি অসাধারণ এক চিকিৎসা পদ্ধতির অবতারণা করে গিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ্। এই কথায় অনেক আবেগ থাকলেও, সত্যটা ঠিক এমন নয়। বরং ব্যাপারটা এমন যে, রাসূল সাঃ তৎকালীন সময়ে প্রচলিত এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে তাঁর উম্মাহর জন্যে ‘অনুমোদন’ দিয়ে গিয়েছেন। অবশ্য শুধু ‘অনুমোদন’ বললে কম হবে। বরং তিনি বলে গিয়েছেন, এটা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি।
চলুন জেনে নেয়া যাক এর উৎসটা আসলে কোথায়?
গুছিয়ে বলতে গেলে, মানব সভ্যতার এক অনন্য আবিষ্কার এই কাপিং থেরাপি। কিন্তু কারা কবে প্রথম এই পদ্ধতির অবতারণা করেছেন তা পরিষ্কারভাবে বলা মুশকিল। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর নিদর্শন ঘেটে আমরা অনেক অনেক কাল আগ থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ও জাতিতে এর প্রচলনের কথা দেখতে পাই।
অসিরীয় নামে এক জাতি বাস করত টাইগ্রিস নদীর তীরে। সে প্রায় ঈশা আঃ এর জন্মের ৩৫০০ বছর আগের কথা। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৫৫০০ বছর আগের কথা। আরব ঐতিহাসিকদের মতে, এরাই প্রথম আরবদের মধ্যে কাপিং এর প্রচলন করে।
আরবরা কাপিং থেরাপির নাম দিল আল হিজামা থেরাপি। যার অর্থ হচ্ছে, কোন কিছুকে তার প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া। তারা, উচ্চ রক্তচাপ, পলিসাইথেমিয়া, মাথা ব্যাথা, মাইগ্রেন এবং বিভিন্ন প্রকার বিষক্রিয়ার চিকিৎসায় ব্যাবহার করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজও হাসপাতালগুলোতে ভেনিসেকশানের মাধ্যমে পলিসাইথেমিয়ার চিকিৎসা করা হয়।
সুন্নাহ হিসেবে এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় মুসলিমদের মাঝে যখন মে’রাজের রাতে ফেরাশতারা রাসূল সা: এর উম্মাহ কে হিজামার জন্যে হুকুম করতে বলেন!
ইবনে সিনা (৯৮০ – ১০৩৭ খ্রীস্টাব্দ) এর নাম আমরা সবাই জানি। তিনি ছিলেন একাধারে প্রসিদ্ধ ইসলামিক দার্শনিক, স্কলার,কবি অন্যদিকে ছিলেন ইতিহাস বরেন্য চিকিৎসক। মনোরোগবিদ হিসেবে তার বিশেষ সুনাম ছিল তাঁর লেখা ‘The Canon of Medicine’ সারা বিশ্বে টেক্সটবুক হিসেবে ব্যবহৃত হত।
হিজামার উল্লেখ তিনি সেই বইয়ে করেছেন।মজার ব্যাপার ইবনে সিনা হিজামা এবং ড্রাই কাপিং দুটোর ব্যবহারকেই উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধক, রক্ত পরিশুদ্ধিকারক এবং Deep Tissue Inflammation এর ক্ষেত্রে তিনি হিজামার উপকারিতার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরেক প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আল রাজি( ৮৬৫ – ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও হিজামা এবং ড্রাই কাপিং কে ট্রেডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
চাইনিজদের মধ্যে জি-হং(৩৮১-২৮১খ্রিষ্টপূর্ব) হচ্ছেন এই কাপিং থেরাপির পথিকৃৎ। সেই থেকেই চাইনিজরা কাপিং থেরাপির চর্চা করে আসছে। সেই থেকে আজ প্রায় ২০০০ বছর অব্দি এই কাপিং থেরাপি Traditional Chinese medicine এর অংশ হয়ে আছে। এবং ১৯৫০ সাল থেকে চীনের হাসপাতালগুলোতে এই কাপিং থেরাপি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই করা হচ্ছে।
পৃথিবীর বহু প্রাচীন সভ্যতার এক চারণভূমি ছিল মিশর। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালেও সেখানে কাপিং থেরাপির প্রচলন ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়। প্যাপিরাস পাতায় এবং বিভিন্ন শিলালিপি থেকে প্রমান পাওয়া যায়, সে সময়ই মিশরীয়রা কাপিং থেরাপিতে বেশ উন্নত ছিল।
প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা গ্রিসের নাম ছাড়া শেষ করা কঠিন। গ্রিসেও কিন্তু এই কাপিং থেরাপির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালে, হেরডটাস- যিনি একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, তার লেখা থেকে জানা যায়, তখনকার সময় সেখানে মিশরীয় ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্য ড্রাই কাপিং এবং ওয়েট কাপিং ব্যাবহার করতেন। এবং এর মাধ্যমে তারা মাথা ব্যাথা, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ফোঁড়া পরিষ্কার করা, দিনভর ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি সমস্যার চিকিৎসা করতেন।
প্রাচীন মেসেডনিয়াতে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালেও এর প্রচলন ছিল। এবং জানা যায়, তারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বিভিন্ন সমস্যার জন্য ব্যাবহার করে আসছিল।
পরিশেষে বলা যায়, মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে যেমন কাপিং থেরাপি ছিল, মানব সভ্যতা যখন উন্নতির চরম শিখড়ে উঠে যাচ্ছে, তখনও কাপিং থেরাপি একইভাবে কার্যকর। মানব সভ্যতার মহান এই আবিষ্কারকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। আশা করছি, গবেষকগণ এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও গবেষণা করবেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজে এর যথাযথ গুরুত্ব তুলে ধরবেন।
ডাঃ মোঃ রহমতউল্যাহ শুভ
M.B.B.S (China)
Specialty in Traditional Chinese Medicine